সৌদি আরবে কর্মসংস্থানের সুযোগ নিয়ে প্রতিবছর হাজার হাজার বাংলাদেশি ও অন্যান্য দেশের নাগরিক সেখানে পাড়ি জমান। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দালালচক্রের প্রতারণা ও সরকারি নিয়মের ব্যাপক পরিবর্তনের কারণে অনেকেই বিপদে পড়ছেন। এই প্রতিবেদনে আমরা সৌদি আরবে বৈধভাবে কাজের জন্য প্রয়োজনীয় সব নিয়ম, দালালদের কৌশল এবং সরকারের নতুন সতর্কতামূলক পদক্ষেপগুলো বিশদভাবে আলোচনা করব।
সৌদি আরবে বৈধভাবে কর্মী নিয়োগের সঠিক প্রক্রিয়া
সৌদি আরবে বৈধভাবে কর্মী নিয়োগের জন্য প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে অবশ্যই সরকার অনুমোদিত পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। সঠিক প্রক্রিয়াটি নিম্নরূপ:
1.কোম্পানির ভিসা ইস্যু:
সৌদি নাগরিক, নিবন্ধিত কোম্পানি (মুয়াস্সাসা) বা বৈধ ব্যবসায়ী লাইসেন্সধারী (ইনভেস্টর) কর্মী প্রয়োজন অনুযায়ী কর্মী ভিসা ইস্যু করবেন।
এই ভিসা শুধুমাত্র নির্দিষ্ট পদের জন্য বৈধ এবং এর মাধ্যমে বাংলাদেশ বা অন্য কোনো দেশ থেকে কর্মী আনা হয়।
2. Qiwa পোর্টালে এগ্রিমেন্ট রেজিস্ট্রেশন:
কর্মী নিয়োগের আগে নিয়োগকর্তাকে অবশ্যই Qiwa (সৌদি শ্রম মন্ত্রণালয়ের অনলাইন সিস্টেম) এ এগ্রিমেন্ট রেজিস্ট্রেশন করতে হবে।
এই এগ্রিমেন্টে বেতন, কাজের ধরন, চুক্তির মেয়াদ ইত্যাদি উল্লেখ থাকবে।
3. কর্মীর আগমন ও ইকামা প্রক্রিয়া:
কর্মী সৌদি আরবে পৌঁছানোর পর ৯০ দিনের মধ্যে তাকে অবশ্যই ইকামা (কর্ম অনুমতি) নিতে হবে।
ইকামা না নিলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফাইনাল এক্সিট (চূড়ান্ত বহিষ্কার আদেশ) জারি হবে।
সৌদি আরবে দালালদের প্রতারণার কৌশল: কীভাবে তারা মানুষকে ফাঁদে ফেলে?
অনেক দালাল ও অসাধু এজেন্ট সৌদি আরবে কর্মী পাঠানোর নামে প্রতারণা করছে। তাদের সাধারণ কৌশলগুলো হলো:
১. ভুয়া মুয়াস্সাসা (কোম্পানি) তৈরি করে ভিসা ইস্যু করা
– তারা নকল কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন করে হাজার হাজার ভিসা বের করে।
– এই ভিসাগুলো প্রকৃতপক্ষে কোনো চাকরির সুযোগ তৈরি করে না।
২. “৩ মাসের ইকামা” নামে বিভ্রান্তি ছড়ানো
– সৌদি সরকার নতুন আগত কর্মীদের পাসপোর্ট স্ট্যাম্পে ৯০ দিনের বৈধতা দেয় (এটি ইকামা নয়)।
– দালালরা এটিকে “৩ মাসের ইকামা” বলে চালিয়ে দেয়, যা সম্পূর্ণ ভুল তথ্য।
৩. কর্মীকে এসে পরিত্যাগ করা
– অনেক ক্ষেত্রে কর্মী সৌদি পৌঁছানোর পর দালাল বা নিয়োগকর্তা তাকে পরিত্যাগ করে।
– ফলে কর্মী ইকামা ছাড়াই থেকে যায় এবং **অবৈধ অভিবাসী** হিসেবে গণ্য হয়।
৪. জবরদস্তি করে পাসপোর্ট আটকানো
– কিছু অসাধু নিয়োগকর্তা কর্মীর পাসপোর্ট জব্দ করে রাখেন, যাতে সে অন্য চাকরিতে যেতে না পারে।
– এতে কর্মীটি কাফালা সিস্টেমে আটকা পড়ে এবং শোষণের শিকার হয়।
সৌদি সরকারের নতুন নিয়ম: কী পরিবর্তন হলো?
সৌদি সরকার অবৈধ অভিবাসন ও মানব পাচার রোধে কঠোর নিয়ম জারি করেছে। নতুন নিয়মগুলো হলো:
১. Qiwa সিস্টেম বাধ্যতামূলক
– এখন সব এগ্রিমেন্ট Qiwa পোর্টালে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে।
– কোনো প্রতিষ্ঠান সরাসরি চুক্তি করলে তা অবৈধ বলে গণ্য হবে।
২. ৯০ দিনের মধ্যে ইকামা বাধ্যতামূলক
– নতুন কর্মীকে অবশ্যই ৯০ দিনের মধ্যে ইকামা নিতে হবে, নাহলে অটো ফাইনাল এক্সিট জারি হবে।
– এরপর সে অবৈধ অভিবাসী হিসেবে গণ্য হবে এবং জেল-জরিমানার শিকার হবে।
৩. কাফালা পরিবর্তনের সুযোগ
– কর্মী যদি বর্তমান নিয়োগকর্তার সাথে সমস্যায় পড়ে, তাহলে **কাফালা পরিবর্তন** করতে পারবে।
– তবে নতুন নিয়োগকর্তাকে অবশ্যই Qiwa তে এগ্রিমেন্ট নিবন্ধন করতে হবে।
৪. অবৈধ কর্মীর বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি
– ইকামা ছাড়া থাকলে প্রতিদিন ১০০০ রিয়াল জরিমানা হতে পারে।
– কিছু ক্ষেত্রে গ্রেফতার, জেল ও দেশ থেকে বহিষ্কার পর্যন্ত হতে পারে।
—
নতুন কর্মীদের জন্য করণীয়: কীভাবে নিরাপদে কাজ করবেন?
সৌদি আরবে বৈধভাবে কাজ করতে চাইলে এই পদক্ষেপগুলো অনুসরণ করুন:
১. শুধুমাত্র সরকার অনুমোদিত এজেন্সির মাধ্যমে যান
– বাংলাদেশে BMET (বureau of Manpower, Employment and Training) অনুমোদিত রিক্রুটিং এজেন্সি থেকে ভিসা নিন।
– দালাল বা অননুমোদিত এজেন্টের মাধ্যমে ভিসা নেওয়া থেকে বিরত থাকুন।
২. Qiwa এগ্রিমেন্ট যাচাই করুন
– সৌদি যাওয়ার আগেই নিশ্চিত হয়ে নিন যে আপনার এগ্রিমেন্ট Qiwa পোর্টালে রেজিস্ট্রার্ড কিনা।
– এগ্রিমেন্টে **বেতন, কাজের শর্ত ও মেয়াদ** পরিষ্কারভাবে উল্লেখ থাকতে হবে।
৩. ৯০ দিনের মধ্যে ইকামা নিন
– সৌদি পৌঁছানোর পর দ্রুততম সময়ে ইকামা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করুন।
– যদি নিয়োগকর্তা ইকামা না দেয়, তাহলে সৌদি শ্রম মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করুন।
৪. পাসপোর্ট নিজের কাছে রাখুন
– কোনো অবস্থাতেই পাসপোর্ট নিয়োগকর্তার কাছে জমা দেবেন না।
– পাসপোর্ট আটকালে সৌদি পুলিশ বা বাংলাদেশ দূতাবাসে যোগাযোগ করুন।
৫. সমস্যা হলে দূতাবাসে যোগাযোগ করুন
– যদি আপনি শোষণ বা প্রতারণার শিকার হন, তাহলে বাংলাদেশ দূতাবাস, রিয়াদ বা জেদ্দায় যোগাযোগ করুন।
– দূতাবাসের হেল্পলাইন: +966 11 482 1836 (রিয়াদ), +966 12 665 8244 (জেদ্দা)
উপসংহার: সতর্ক থাকুন, নিরাপদে কাজ করুন
সৌদি আরবে কাজ করতে গিয়ে অনেকেই দালালের ফাঁদে পড়ে বিপদে পড়েন। তাই **সরকারি নিয়ম মেনে, বৈধ পথে কাজের সুযোগ নিন। Qiwa এগ্রিমেন্ট ও ইকামা না থাকলে আপনি অবৈধ অভিবাসী হিসেবে গণ্য হবেন, যা আপনার জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে।
প্রবাস জীবন হোক সচেতনায়, হোক নিরাপদ—এই নীতি মেনে চলুন এবং অন্যকেও সচেতন করুন।
সতর্কতা: কোনো অননুমোদিত এজেন্ট বা দালালের প্রলোভনে পড়বেন না। সরকারি নিয়ম জানতে সৌদি শ্রম মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট (https://qiwa.sa)এবং বাংলাদেশ দূতাবাস, রিয়াদ এর সাথে যোগাযোগ করুন।
সৌজন্যে: saudibdsp (saudi bangladeshi digital service platform)